সরস্বতী মহাভাগে
বাঙালির বিশ্বপরিচয়ে জড়িয়ে আছে বিদ্যা ও শিল্প চর্চার প্রতি প্রগাঢ় প্রেম । আর বারো মাসে তেরো পার্বণের তালিকায় সবচেয়ে মিষ্টি দিনটা বোধহয় সেই বিদ্যাং দেহীর আরাধনা !
১৯৭১ এর শুরুতে শ্রী রমেন চক্রবর্তী গুটিকয়েক প্রবাসী বাঙালি পরিবারকে একত্রিত করে প্রথম যে সরস্বতী পুজোর আয়োজন করেছিলেন, সেই পরম্পরা আজও সাড়ম্বরে পালিত হয়ে চলেছে । প্রতি বছরের ন্যায় এবারও সম্প্রতি ১২ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ বে এরিয়া প্রবাসী মেতে উঠেছিল বাণীবন্দনায়।
প্রবাসের মাটিতে সরস্বতী পুজোয় চিরকাল দুই ধারার আবেগের মেলবন্ধন ঘটে; একপক্ষ যাদের শৈশব বা কৈশোর কেটেছে বাংলার মাটিতে, তাদের কাছে সরস্বতী পুজো মানেই খাগের কলম, কালির দোয়াত, নতুন কুলের স্বাদ, স্কুলের পুজোর উত্তেজনা, বাসন্তীরঙা শাড়ির স্মৃতিমেদুরতা, আর অপরপক্ষ হলো প্রবাসীর আগামী প্রজন্ম, কচিকাঁচার দল, যারা রোজকার জীবনে বাংলায় অনভ্যস্ত হয়েও নিজেদের সেরাটা দিয়ে চেষ্টা করে পুজোয় বাংলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশনার । আর বে এরিয়া প্রবাসীর মঞ্চ বরাবর স্থানীয় মেধার বিকাশে এবং নতুন প্রজন্মের মধ্যে বাঙালির সাংস্কৃতিক মননশীলতা বাঁচিয়ে রাখতে এক অনন্য ভূমিকা পালন করে চলেছে । সেই ভাবনা থেকেই এবারও অনুষ্ঠান তালিকায় ছিল এক গুচ্ছ খুদে প্রতিভাবান শিল্পীর জমজমাট পারফরম্যান্স ! সেতার, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, আধুনিক গান, ওডিশি বা রবীন্দ্রনৃত্য, কিংবা বাংলা নাটক – মঞ্চ মাতাতে জোরকদমে তাদের মহড়া চলেছে দেড় দুমাস ধরে । এছাড়াও বিশেষ আকর্ষণ ছিল রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত বিশিষ্ঠ নৃত্যগুরু যাঁকে সাক্ষাৎ মা সরস্বতীর বরপুত্রই বলা চলে, সেই শ্রী সঞ্জীব চট্টপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে নৃত্য পরিবেশনা ‘মাতৃকা’ এবং বাংলা ব্যাণ্ড ‘ভালোবাসি তাই গাই’-এর দুর্দান্ত উপস্থাপনা । অনুষ্ঠানের শুরু থেকে শেষ অব্দি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সাবলীলভাবে সঞ্চালনার ভারও সামলেছে প্রবাসীর তরুণ তাজা মুখগুলো ।
বাচ্চা থেকে বড় সকলের বিনোদনের জন্যে ছিল ম্যাজিক শোয়ের ব্যবস্থা । তবে সবচেয়ে বেশী নজর কেড়েছে ‘বসে আঁকো’ প্রতিযোগিতা। ৩-৫, ৫-৯ ও ১০+ বয়স অনুযায়ী তিনটে ক্যাটিগরিতেই বাচ্চাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মত ! একরত্তি একবছরের একটা পুচকেও তার মায়ের কোলে বসে মন দিয়ে বসন্তের ছবি আঁকছিল – বাগদেবীর অর্চনায় এরচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত আর কি বা হতে পারে ! প্রতিযোগিতার শেষে ছিল সমস্ত কচি হাতের শিল্পকলার মনোমুগ্ধকর প্রদর্শনী ।
এবছর কোলকাতা থেকে সদ্য আগত নতুন প্রতিমা, ডাকের সাজ উদ্বোধনের পাশাপাশি বে এরিয়া প্রবাসীর এক অত্যন্ত প্রতিভাবান সদস্য পরিবার চমক রেখেছিল চালচিত্র সজ্জায় । তাঁদের অভূতপূর্ব শিল্পনৈপুণ্যে মণ্ডপের রূপই অন্য মাত্রা পেয়েছিল । প্রবাসীর পুজোয় হলুদ-সাদা শাড়ী পাঞ্জাবীর অঞ্জলির ভিড় তো প্রত্যেক বছরের চেনা ছবি, এবারও চার দফায় পুষ্পাঞ্জলির পর ছিল প্রসাদ বিতরণের লম্বা লাইন ! আর সরস্বতী পুজোর ঐতিহ্য মেনে হাতেখড়ির আয়োজন তো বলার অপেক্ষা রাখে না ! বীণাপাণির চরণতলে সন্তানের প্রথম ওই কালো স্লেটের ওপর দু-এক অক্ষর লেখা নিঃসন্দেহে সব বাঙালি বাবামায়ের জীবনের অন্যতম আবেগঘন মুহূর্ত । ভাষা, সংস্কৃতি, দেশ নির্বিশেষে জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর কাছে একটাই প্রার্থনা থাকে সকলকে বিদ্যা দাও, বুদ্ধি দাও। জীবনের সিংহভাগ জুড়ে থাকুক বাণীবিদ্যাপ্রদায়িনীর কৃপা ।
খোদ শ্রীপঞ্চমীতে জমিয়ে খাওয়া দাওয়া ছাড়া উদযাপন সম্পূর্ণ হয় না কি ! বরাবরের মতো পুজোর ভোগ রান্নার দায়িত্ব সামলেছেন কিছু সদস্য পরিবার । এছাড়াও ছিল সকলের জন্যে সুবাসিত খিচুড়ি, তরকারি, বেগুনী, পাঁপড় আর চাটনি সহযোগে মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা। আর খাদ্যরসিক বাঙালির রসনাতৃপ্তির জন্য বিকেলের চা-চপ-সিঙ্গারার তো বিকল্প হয় নাহ্; আর সেই ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ হাতে সিঙ্গারায় কামড় দিতে দিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করা সন্ধ্যেটাকে যেন আরো প্রাণবন্ত করে তুলেছিল !
মিলপিটাসের ইণ্ডিয়ান কমিউনিটি সেন্টারের পুজো প্রাঙ্গণ সমস্ত দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত রাখার পাশাপাশি অতিমারির কারণে প্রত্যেকের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে প্রবেশের আগে কোভিড পরীক্ষা ছিল বাধ্যতামূলক । এছাড়াও ছিল টেম্পারেচার চেকের ব্যবস্থা । সবরকম কোভিড বিধি মেনে এত বড় আয়োজন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার পিছনে বে এরিয়া প্রবাসীর ভলেণ্টিয়ার্স টিমের নিরলস পরিশ্রম বলাই বাহুল্য ! এবং তাঁদের এই আন্তরিক স্বেচ্ছাশ্রমকে সম্মান জানাতে বে এরিয়া প্রবাসী গর্বিত যে তারা সম্প্রতি প্রেসিডেন্টের সাক্ষরিত ভলেণ্টিয়ার্স সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড প্রদানে অনুমোদিত সংস্থা ।
শীত শেষে বসন্ত আসে, এক উৎসবের সমাপন অন্য আরেক উদযাপনের প্রস্তুতি সূচনা করে । বে এরিয়া প্রবাসীর বছরভর নানাবিধ সামাজিক কর্মকাণ্ডে ও সদস্যপদ গ্রহণে আপামর সব্বাইকে সাদর আমন্ত্রণ ! সকলের সমবেত উদ্যোগ, সার্বিক উপস্থিতি তো আসলে পরস্পরের সঙ্গে আরো বেঁধে বেঁধে থাকার উপলক্ষ্য । আসন্ন বসন্তোৎসব, বৈশাখী বা চড়ুইভাতিতে তাহলে দেখা হচ্ছে তো সবার সঙ্গে ?